রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনার লিখিত পদত্যাগপত্র না পাওয়ার কথা বললে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তার বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক ছাত্ররা এরইমধ্যে রাষ্ট্রপতিকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন। এই দাবিতে ২২ অক্টোবর শহীদ মিনারে সমাবেশ ও বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের চেষ্টা করা হয়। তারা রাষ্ট্রপতিকে পদ ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এর মধ্যে পদত্যাগ না করলে তারা বঙ্গভবন ঘেরাওসহ আন্দোলন গড়ে তুলবেন বলে জানিয়েছেন।


এদিকে রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের বিষয়ে সংবিধানের ৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যাবে। এর জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে অনুরূপ অভিযোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে প্রদান করতে হবে। স্পিকারের কাছে অনুরূপ নোটিশ প্রদানের দিন থেকে ১৪ দিনের আগে বা ৩০ দিনের পর এই প্রস্তাব আলোচিত হতে পারবে না, এবং সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে স্পিকার অবিলম্বে সংসদ আহ্বান করবেন এবং (৪) উপ-অনুচ্ছেদ মোতাবেক, অভিযোগ-বিবেচনার পর মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অভিযোগ যথার্থ বলে ঘোষণা করে সংসদ কোনও প্রস্তাব গ্রহণ করলে, প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার তারিখে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।’

এছাড়া সংবিধানের ৫৩(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপসারিত করা যাবে। এর জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের নিকট প্রদান করা এবং উপ-অনুচ্ছেদ (২) অনুসারে সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে নোটিশ প্রাপ্তিমাত্র স্পিকার সংসদের অধিবেশন আহ্বানের বিধান রয়েছে।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। যেহেতু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন— সেহেতু সংবিধানের ৭৪(৬) অনুসারে স্পিকারের পদত্যাগ সত্ত্বেও তিনি স্পিকার থেকে যাবেন এবং রাষ্ট্রপতির সব কর্মকাণ্ড স্পিকারের ওপর ন্যস্ত হবে। তবু সংবিধানের দুটো অনুচ্ছেদ জরুরি—অনুচ্ছেদ ৭৪(৬) এবং অনুচ্ছেদ ৫৪।’

সংবিধানের পঞ্চম ভাগে আইনসভা অংশে অনুচ্ছেদ ৭৪(৬)-এ বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলি সত্ত্বেও ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে। আর (২) দফায় বলা হয়েছে, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের পদ শূন্য হবে, যদি (ক) তিনি সংসদ-সদস্য না থাকেন; (খ) তিনি মন্ত্রী-পদ গ্রহণ করেন; (গ) পদ হতে তার অপসারণ দাবি করে মোট সংসদ-সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সমর্থিত কোনও প্রস্তাব (প্রস্তাবটি উত্থাপনের অভিপ্রায় জ্ঞাপন করে অন্যূন ১৪ দিনের নোটিশ প্রদানের পর) সংসদে গৃহীত হয়; (ঘ) তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে তার পদ ত্যাগ করেন; (ঙ) কোনও সাধারণ নির্বাচনের পর অন্য কোনও সদস্য তার কার্যভার গ্রহণ করেন; অথবা (চ) ডেপুটি স্পিকারের ক্ষেত্রে তিনি স্পিকারের পদে যোগদান করেন।’

আর সংবিধানের চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ অংশে অনুচ্ছেদ ৫৪-তে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনও কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য হলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।’

তাহলে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হবে কীভাবে তার জবাবে আহসানুল করিম বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হয় না। রাষ্ট্রপতি শুধু সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।’

সংবিধানে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ সম্পর্কে ৪৮(১) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ-সদস্যরা কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।’

প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে কিনা প্রশ্নে আহসানুল করিম বলেন, ‘কোনও সুযোগ নেই। কারণ বিচার বিভাগ একটি আলাদা বিভাগ। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রধান বিচারপতিকেও দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই।’

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের কাছে রাষ্ট্রপতি পরামর্শ চাইতে পারবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কে সেই পরামর্শ চাইবেন এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘দেশে সাংবিধানিক সংকট চলছে। কেননা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যে বৈধতা দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিকভাবে হয়নি। সেটিতে আইনগত ও বস্তুগত ভুল রয়েছে। আর এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে সেই সংকট আরও প্রকট হবে। এখন স্পিকার নেই, সংসদ নেই। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হয় সংসদের মাধ্যমে। তবে পদত্যাগের আগে রাষ্ট্রপতি যদি সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স চান, তাহলে সেটি ভিন্ন বিষয়। তখন সুপ্রিম কোর্ট অ্যামিকাস কিউরি (আদালত বন্ধু) নিয়োগের মাধ্যমে, রাজনৈতিক দল বা সংগঠন ও পদত্যাগ দাবিকারী ছাত্রদের বক্তব্যও লিখিতভাবে শুনতে চাইতে পারেন। এখনও দেশের কয়েকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাদের বক্তব্যও নিতে পারেন। এরপর পক্ষে-বিপক্ষে সবার বক্তব্য শুনে সুপ্রিম কোর্ট তাদের আদেশের মাধ্যমে রেফারেন্স দিতে পারে। তবে এর বাইরে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ নিয়েও সংকট তৈরি হবে। এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সুয়োমোটে রুল জারিরও এখতিয়ার নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিকে অনেকেই ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র (প্রয়োজনীয়তার মতবাদ বা বিশেষ পরিস্থিতির নীতি) কথা বলছেন। কিন্তু একজন আইনজীবী হিসেবে আমি এটিকে ডকট্রিন অব নেসেসিটি বলতে চাই না। আমি মনে করি এটি ‘ডকট্রিন অব নিউ নরমাল’। ফলে আইনগত দিক ফাঁকা রেখে কোনোকিছু করলে পরবর্তীকালে আইন করে সবকিছু বাদ করার সুযোগ থেকে যাবে। সবার গ্রহণযোগ্যতার জন্য এখন একটি ফ্রেশ রেফারেন্স আদালতের থেকে আনা উচিত’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

কার্টেসি: বাংলা ট্রিবিউন